হাওয়া
![]() |
হাওয়া |
ব্রিটিশ সাহিত্যে রোমান্টিক যুগের নাম আসলেই যার বা যাদের নাম স্বভাবতই আগে আসে তারা হলেন বিখ্যাত ইংলিশ কবি স্যামুয়েল টেইলর কলেরিজ এবং উইলিয়াম ওর্ডসোর্থ (আমার অত্যন্ত প্রিয় কবি) যাদের অনবদ্য লিরিক্যাল ব্যালাডের প্রথম সংস্করণেই যে কিংবদন্তি দীর্ঘকায় কবিতা "দ্য রাইম অব এন্সিয়েন্ট মেরেইনার" (The Rime of Ancient Mariner) সৃষ্টি করেছিলেন এস.টি. কলেরিজ। কবিতাটির মূল বিষয়ের সাথে গ্রীক পুরানের (Greek Mythology) একটা ঝাপসা কিন্ত দৃঢ় এক সম্পর্কের ফলাফল পরিবর্তিত হয় এক অন্যরকম পরিণতিতে! তার আগে এই দুই বিষয়ের মূল ধারণাটা দেখে আসি।
(ঘটানাগুলো অনেকের কাছেই দুর্বোধ্য বা মাথামুণ্ঢীন মনে হতে পারে, কিন্তু ঘটনার পিছনের ঘটনা অশেষ তাই শুধু আপাত, অনূদিত ও সংক্ষেপভাবে সামর্থানুযায়ী আলোকপাত, তাই আগে পড়েন বা পরে পড়েন, কিন্তু অবশ্যই পইড়েন তাহলে মুভি দেখা ছাড়াও অন্যরকম ভালোলাগা অনির্ণেয় হয়ে বিরাজ করবে।)
.
গ্রীক পুরানে টাইটান প্রমিথিউস (Prometheus) ছিলো অগ্নি দেবতা এবং একই সাথে ধূর্ত এবং নামের স্বার্থতকার বাহক ছিলো। গ্রীক শব্দ প্রমিথিউস যার অর্থ বা ভবিষ্যৎদর্শী (Foresight) বলা হয়। সে নিয়োজিত ছিল মানুষ সৃষ্টি জন্য, আর অন্যান্য সৃষ্টি (প্রানি, উদ্ভিদ, পাহার, সমুদ্র ইত্যাদি) ছিল অন্যান্য দেবতাদের অধীনে। এদিকে প্রমিথিউসের আরেক ভাই এপিমেথিউস (Epimetheus) ছিল জীবদের সার্বিক রক্ষনাবেক্ষনের দ্বায়িত্বে, তো প্রমিথেউসের পুত্র ডিউক্যালিয়ন (Deucalion) (নোয়াহ এর সমমান ধরা হয়) তার স্ত্রী পরিজন নিয়ে একটি মহাপ্লাবনে অস্তিত্ব নিয়ে সন্দিহান, ঠিক তখনই এপিমেথিউস সমগ্র প্রানি সাহায্য করতে করতে এসে পড়ে এবং দুর্ভাগ্যবশত সে খেয়ালই করেনি যে তার সাহায্যের ডালি শেষ।
.
প্রমিথিউস তার চতুরতা দিয়ে হেফাস্টস এবং এথেনার কর্মশালা থেকে আগুন চুরি করে মানব সমাজকে দান করে, নির্বোধ মানবসকল আগুন দিয়ে কি করা যায় বা কি করবে মাথায় তাদের আসে না, তখন প্রমিথিউস দিক্ষা দিলো ধাতব বস্তুর ব্যবহার আর পুড়িয়ে খাওয়ার প্রথম সভ্যতা। কিন্তু জিউস মোটা দাগে একটি বিষয়ে দৃষ্টি দিলেন তা হলো চুরি, সেই কারণেই প্রমিথিউসকে চিরন্তন শাস্তি হিসেবে তাকে দিলে শিকলবন্দী জীবন সাথে নিযুক্ত করলো একটি ঈগল যে প্রমিথিউসের কলিজা প্রতিদিন খেয়ে চলে যাবে আবার পরের দিন এসে একই ঘটনা পুনরাবৃত্তি করবে কারণ অমর দেবতার কলিজাও অমর, খেলে কি হবে রাতে আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসে। এই অনন্তকালের শাস্তি থেকে মুক্তির কথা আরো বৃহৎ কোন এক সময় সেটা বর্ণনা করা যাবে। এরপর, জিউস মানুষই কেন সেই আগুন নিলো, কি করলো না করলো তা জানার বিষয় না জিউসের কাছে। কেন নিল, কেন অবাধ্য এই মানবসকল তাদের জন্য ক্রোধান্বিত জিউস হেফাস্টলসকে নির্দেশ দিলো, বানাও এক মানবী যাকে পৃথিবীতে পাঠাবো আর এক হিম শীতল ভাগ্যের খেলা উপভোগ করবো। তাই সৃষ্টি হলো প্যান্ডোরা, যে একই সাথে রোগ, শোক, ব্যাধি, হিংসা, জরা, লোভ এবং মৃত্যুর মত বর্ণাঢ্য উপাদানগুলো বাহক এবং সংক্রামক। এরপর বুঝায় যাচ্ছে কি হতে যাচ্ছে প্রমিথিউসের গড়া মানবচরিত্রে।
.
এবার আসি দ্য এনসিয়েন্ট মেরিনার বিরাট কবিতার সারমর্মে, শুরুটা একজন ধূসর রঙা চুল-দাড়ি বয়স্ক একগুঁয়ে এক মেরিনার বা নাবিক যে তার নৌবহরের অন্যান্য কর্মীদের নিয়ে নৌযাত্রা শুরু করে যা দক্ষিণের হাওয়ায় যেতে যেতে এন্টার্ক্টিকার আশে পাশের বরফজমাট কোন স্থানে আটকা পরে। এমন সময় উড়ে আসে একটি আলবাট্রস পাখি, তাকে খাওয়ানো, রেখে দেয়া এবং হঠাৎ তাদের সেই বদ্ধ অবস্থা থেকে নিস্তার। তখনই সেই মেরিনার গুলি করে মেরে ফেললো সেই আলবাট্রস কে, তার চিন্তায় সেটি ছিল কালো ছায়া আর অভিশাপের কারণ, কিন্তু অন্যান্য কর্মীরা প্রথমে অন্ত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেও পরিস্থিতি আর আবহাওয়া অনুকূলে চলে আসায় তারাও একটু নরম হয়। কিন্তু তারা তো জানে না সামনে কি এক ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে তারা কি ভুল ছিল না সঠিক!
.
সবকিছু স্বাভাবিক ঠিক তখনই আবির্ভাব এক স্বত্তার মৃত না মৃত্যুর ঊর্ধ্বে তা অনুমেয় হলেও নিশ্চিত যে সেটা জীবিত নয়। একজন পানির সংস্পর্শে অনেকক্ষন যে তার কেটেছে তা সেই মানবীর ফ্যাকাসে চেহারায় পরিস্কার। এরপর খেলা শুরু হয় মৃত্যুর সাথে তাদের কানামাছি খেলা, ঠিক এই ভবিতব্য নিয়েই বলা যায় সেই মানবীর আবির্ভাব, কেন আবির্ভাব! সেটা প্রায় ধরা যায় সেই পাখির হত্যার শাস্তির মুচলেকা। কিন্তু সবার জন্য একই খেলা হলেও সেই মেরিনারের জন্য এডভান্সড লেভেলের খেলা, আর তা হলো মৃতু তাকে ধরবেনা, কারণ তার শাস্তি মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ। কেমন সেই ভয়াবহতা? কিভাবে এলবাট্রস আর সেই বিবর্ণীল মানবীর সম্পর্কৃত?
.
সেইখান থেকে এখন আসতেছি মেঘদল ব্যান্ডের ভোকাল মেজবাউর রহমান সুমন পরিচালিত বর্তমানের ব্যাপক সাড়া পাওয়া সিনেমা "হাওয়া" এর প্লট আর সৃজনশীল নির্মাণ নিয়ে।
স্পষ্টত, জিউসের (Zeus) পাঠানো ঈগল যার নাম পুরান মতে AETOS KAUKASIOS (Caucasian Eagle), মেরিনারের কাছে আসা এলবাট্রস আর এই সিনেমায় দেখিয়েছে একটি পাখি যার মর্মার্থ শেষে আঁচ করা যায়। আবার জিউসের নির্দেশে মানব সভ্যতায় শাস্তি স্বরূপ প্যান্ডোরার সৃষ্টি এবং প্রেরণ সেইসাথে হাওয়া সিনেমায় সুরমা মাছ বেশে ধরা পড়া এক সুশ্রী মানবী যাকে সবাই এক প্রকার মেনেই নেই প্যান্ডোরার মত সকল দুর্ঘটনার মূল হোতা এবং প্রত্যক্ষ কারণ হিসেবে। গ্রিক পুরাণে প্যান্ডোরা শুধুমাত্র জায়গা পেয়েছিল এপিমিথিউসের ঘরে, এখানে কাছে সে ছিল শুধুই প্রেমময়ী মানবী। প্রমিথিউসের অর্থাৎ চাঁদ সওদাগরের শত বারণ স্বত্ত্বেও এপিথিউমাস অর্থাৎ মি. রাজ তাকে আগলে রেখেছিল শেষ পর্যন্ত। কিন্তু এরপর থামতে হবে, কারণ এরপর পরিচালকের নিজের কারিশমা এবং মৌলিকত্বের শেষ অবধি বিস্তার।
.
এখন আসি সিনেমা হিসেবে আমার কেমন লেগেছে, প্রথমেই আমি অত্যন্ত আনন্দিত এবং গর্বিত যে এমন দুটি বিষয়ের মেল বন্ধন করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সাহস আর কখনও বাংলায় হয় নাই। সেই সাহসিকতা আর আত্মবিশাসকে আমার গভীর শ্রদ্ধা। একই সাথে বলতে হয় সিনেমাটোগ্রাফি,
.
প্রাণখুলে বা তৃপ্তি নিয়ে ভালো লেগেছে বলার ক্ষেত্রে যে জিনিষগুলো একটু বাধা সৃষ্টি করেছে তা হলো, সাউন্ড সিস্টেম আর নির্দিষ্ট কিছু যায়গায় দৃশ্যের অস্পষ্টতা। আমি সিনেপ্লেক্সে দেখছি তাই হয়তো আমার জোড় দিয়ে বলার জায়গাটা দুর্বল। তারপরও যদি বাঙালি মুভিপ্রেমী হিসেবে দেখি তাহলে প্রশংসার অতলে অসুবিধার উপাদান তলিয়ে যায়। আবার যদি গ্লোবাল মুভি খোর হয়ে থাকি তো সেক্ষেত্রে ওই তো বললাম কোন জিনিষগুলো গলাচেপে ধরেছিল দ্ব্যর্থহীন ভাবে বলতেই দেয়নি যে "অসাধারণ একটা মুভি দেখলাম"
.
সর্বাপরি, শেষ দৃশ্যের অংক মিলাতে গিয়ে মনে হচ্ছিলো যে আমি কি অংক মুখস্থ করেছি নাকি শিক্ষকের শেখানোটায় আমি বুঝতেছিনা। খটকা আবার অসামাঞ্জস্য কিছুটা রয়েছে, তবে অবশ্যই বলবনা কাকতালীয়, সেটা হচ্ছে শেষে সুরমা মাছ এর সাপে বিবর্তন এবং মৌলিকত্ব বজায় রাখতে গুল্টি থেকে বিষক্রিয়ায় মুভির ছন্দপতন ('দ্য রাইম অব এনসিয়েন্ট মেরিনার' কবিতায় মেয়েটির নাম ছিল সেই প্রধান মেরিনারের ভাগ্যের সাথে সম্পর্কিত) বলা বাহুল্য গুল্টির আরেক নাম 'মনসা' না রেখে বুদ্ধিমত্তার অন্য এক ছাপ ফেলে গেছেন, যা অন্যান্য ব্যবসায়িক পরিচালকদের জন্য অবশ্য শিক্ষনীয়। মৌলিকত্ব যেন অতি আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি না করে সেটা খেয়াল রেখেই হয়তো পরিচালক পরবর্তী কোন ধামাকা আনবেন সেই প্রত্যাশার বিণির্মাণ অবশ্যই চলছে সবার মধ্যে যারা মুভিটি দেখেছেন।
.
বিঃদ্রঃ এখানে শুধুমাত্র আমার অভিমত আর অনুভূতি দিয়েছি যতটুকু বুঝি তার সীমার ভিতরেই। আমার ভুলা জানা থাকতেই পারে, কম জানা থাকতেই পারে। সেক্ষেত্রে, আপনাদের সহযোগিতা কাম্য, যদি নতুন কিছুর এড করার থেকে থাকে তার জন্য সবিনয়ে স্বাগতম।
0 Comments